ইউরোপে ধনী হওয়ার অন্য পথগুলো কি খোলা আছে?
ইউরোপের সর্বোচ্চ আদালত সম্প্রতি অর্থের বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) কোনো দেশের নাগরিক হওয়ার শেষ সুযোগটিও বন্ধ করে দিয়েছে। মাল্টার 'গোল্ডেন পাসপোর্ট' খ্যাত এই বিতর্কিত কর্মসূচিটি দীর্ঘদিন ধরে সমালোচিত হচ্ছিল। ইউরোপীয় বিচার আদালতের (ECJ)-এর এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকে, যারা মনে করেন নাগরিকত্ব কোনো বাণিজ্যিক পণ্য হতে পারে না।
![]() |
মাল্টার 'গোল্ডেন পাসপোর্ট'-এর দরজা বন্ধ |
মাল্টার নাগরিক সংগঠন রিপাবলিকার নির্বাহী কর্মকর্তা মানুয়েল ডেলিয়া এই রায়ে রীতিমতো উল্লসিত। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার বন্ধু ও সহকর্মী, দুর্নীতিবিরোধী সাংবাদিক দাফনে কারুয়ানা গালিজিয়ার হত্যাকাণ্ড এই ধরনের কর্মসূচির বিপদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল। গালিজিয়ার বিশ্বাস ছিল, এই গোল্ডেন পাসপোর্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে আসা অর্থ মাল্টার দুর্নীতিবাজ চক্রকে আরও শক্তিশালী করছে।
২০২২ সালে ইউরোপীয় কমিশন মাল্টার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়। কমিশনের যুক্তি ছিল, শুধুমাত্র বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব প্রদান EU-এর নাগরিকত্ব নীতির পরিপন্থী। কারণ, নাগরিকত্বের জন্য আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি ব্যক্তির সঙ্গে দেশটির 'প্রকৃত সংযোগ' থাকা আবশ্যক। অক্টোবরে ECJ-এর অ্যাডভোকেট জেনারেল মাল্টার সরকারের পক্ষেই মত দিয়েছিলেন। তাই ডেলিয়ার মতো অনেকেই ভিন্ন রায়ের আশঙ্কা করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত আদালত মাল্টার নাগরিকত্ব নীতিকে নিছক 'বাণিজ্যিক লেনদেন' হিসেবেই দেখেছে। আদালতের স্পষ্ট বক্তব্য, এই ধরনের চর্চা সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা তৈরিতে বাধা দেয়।
ডেলিয়ার মতে, এই রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে এই কর্মসূচি ছিল অর্থ উপার্জনের একটি অনৈতিক উপায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, নাগরিকত্বের কোনো আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা যায় না, এটি অর্থের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। গোল্ডেন পাসপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কতটা কঠোরভাবে শর্তাবলী যাচাই করত, তা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। অভিযোগ রয়েছে, অনেকেই নিয়ম অনুযায়ী মাল্টায় নির্দিষ্ট সময় না থেকেও নাগরিকত্ব পেয়েছেন। দাফনে কারুয়ানা গালিজিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, মাল্টার গোল্ডেন ভিসাপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই ছিলেন চীনা বিনিয়োগকারী। যা দেশটির মোট চীনা জনসংখ্যার তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
তবে একটি দরজা বন্ধ হলেও, ইউরোপে প্রবেশের অন্যান্য পথ কিন্তু এখনো খোলা আছে। গোল্ডেন পাসপোর্টের অনেক সুবিধা 'গোল্ডেন ভিসা'র মাধ্যমে পাওয়া যায়। আবাসন বা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে বসবাসের অনুমতি পাওয়া এখনো সম্ভব। হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের মতো সংস্থা ৩১টি দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে, যার অর্ধেকই EU ভুক্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নীতি বিষয়ক কর্মকর্তা আনা টেরন মনে করেন, এর মাধ্যমে এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক স্বাধীনতা উপভোগ করা যেতে পারে।
তবে ইউরোপীয় কমিশন এই গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচিগুলো নিয়েও 'গুরুতর উদ্বেগ' প্রকাশ করেছে। কমিশনের মুখপাত্র মার্কুস লেমার্ট মনে করেন, এই ধরনের কর্মসূচিগুলো নিরাপত্তা ঝুঁকি, অর্থ পাচার, কর ফাঁকি ও দুর্নীতির মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই সদস্য দেশগুলোর এমন কর্মসূচির ক্ষেত্রে যথাযথ ঝুঁকি মোকাবিলা ব্যবস্থা থাকা জরুরি। ২০২২ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি রেজ্যুলেশনে বিনিয়োগের বিনিময়ে বসবাসের সুবিধা স্কিমের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও, ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি এখনো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উপরই ন্যস্ত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের টেরন আশা করছেন, গোল্ডেন পাসপোর্ট বন্ধের এই যুক্তির ভিত্তিতে গোল্ডেন ভিসার ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। তিনি মনে করেন, আদালত যে যুক্তিতে গোল্ডেন পাসপোর্ট বন্ধ করেছে, তা গোল্ডেন ভিসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। EU দেশগুলোর সংহতি ও নিরাপত্তার স্বার্থে 'দুর্নীতিবাজ এবং অস্বচ্ছ উপায়ে সম্পদশালী হওয়াদের' দূরে রাখা প্রয়োজন।
অন্যদিকে, মানুয়েল ডেলিয়ার বিশ্বাস, নাগরিকত্ব হওয়া উচিত ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি আইনি চুক্তি, যা পারস্পরিক বসবাসের প্রতিশ্রুতি ও সংহতির উপর ভিত্তি করে গঠিত। তিনি মনে করেন, যখনই নাগরিকত্বের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়, তখনই তার মর্যাদা কমে যায়।
এই রায়ের ফলে মাল্টার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট আবেলা অবশ্য কর্মসূচিটির পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এবং আদালতের রায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই ব্যবস্থা চালু রাখার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে মাল্টাকে নতি স্বীকার করতে হবে কিনা, তা সময়ই বলবে। আপাতত, অর্থের বিনিময়ে ইউরোপীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ বন্ধ হলো, তবে ধনী বিনিয়োগকারীদের জন্য অন্যান্য বিকল্পগুলো এখনো আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ):
প্রশ্ন: গোল্ডেন পাসপোর্ট কি?
উত্তর: গোল্ডেন পাসপোর্ট হলো একটি কর্মসূচি যার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের বিনিময়ে কোনো দেশের নাগরিকত্ব লাভ করতে পারত। মাল্টা ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের শেষ দেশ যেখানে এই কর্মসূচি চালু ছিল।
প্রশ্ন: ইউরোপীয় আদালত কেন মাল্টার গোল্ডেন পাসপোর্ট কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছে?
উত্তর: ইউরোপীয় আদালতের মতে, মাল্টার এই কর্মসূচিটি EU-এর নাগরিকত্ব নীতির পরিপন্থী। আদালত এটিকে নিছক বাণিজ্যিক লেনদেন হিসেবে দেখেছে এবং মনে করে নাগরিকত্বের জন্য আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি ব্যক্তির সঙ্গে দেশটির 'প্রকৃত সংযোগ' থাকা আবশ্যক।
প্রশ্ন: গোল্ডেন পাসপোর্ট বন্ধ হওয়ার পর ইউরোপে নাগরিকত্ব পাওয়ার কি অন্য কোনো পথ খোলা আছে?
উত্তর: গোল্ডেন পাসপোর্ট বন্ধ হলেও, 'গোল্ডেন ভিসা'র মাধ্যমে এখনো অনেক ইউরোপীয় দেশে বসবাসের অনুমতি পাওয়া যায়। এটি মূলত আবাসন বা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
প্রশ্ন: গোল্ডেন ভিসা নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের উদ্বেগ কী?
উত্তর: ইউরোপীয় কমিশন মনে করে গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচিগুলো নিরাপত্তা ঝুঁকি, অর্থ পাচার, কর ফাঁকি ও দুর্নীতির মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে।
প্রশ্ন: এই রায়ের ফলে ভবিষ্যতে কী পরিবর্তন আসতে পারে?
উত্তর: অনেকে আশা করছেন, গোল্ডেন পাসপোর্ট বন্ধের এই যুক্তির ভিত্তিতে গোল্ডেন ভিসার ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
0 Comments